উত্তরায় বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত বেড়ে ২০

উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে বিধ্বস্ত হওয়া বিমান ও ঘটনাস্থলে উদ্ধার তৎপরতা
উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে বিধ্বস্ত হওয়া বিমান ও ঘটনাস্থলে উদ্ধার তৎপরতা

রাজধানী ঢাকার উত্তরা এলাকায় একটি ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ জনে। বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে আছড়ে পড়লে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।

সোমবার (২১ জুলাই) দুপুর ১টা ১৮ মিনিটে বিমানটি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিধ্বস্ত হয়। এর ১২ মিনিট আগে, দুপুর ১টা ৬ মিনিটে বিমানটি উড্ডয়ন করেছিল। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম বিমানটি চালাচ্ছিলেন এবং তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন বিমানটিকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যেতে, যাতে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা না ঘটে।

তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিমানটি দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুলের দোতলা ভবনে ধাক্কা খায় এবং সঙ্গে সঙ্গে ভয়াবহ আগুন ধরে যায়। ঘটনাস্থলে একজন শিক্ষার্থী প্রাণ হারান বলে জানায় আইএসপিআর (আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর)।

ঘটনার পর আইএসপিআর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বিমানের ধ্বংসস্তূপ এবং আগুনে দগ্ধ হয়ে এখন পর্যন্ত ২০ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। এছাড়া আরও ১৭১ জন আহত অবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

বিভিন্ন হাসপাতালের আহত ও নিহতের তালিকা আইএসপিআর জানিয়েছে নিম্নরূপ:

  1. কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল: আহত ৮ জন, নিহত নেই

  2. জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট: আহত ৭০ জন, নিহত ২

  3. ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল: আহত ৩ জন, নিহত ১

  4. সিএমএইচ ঢাকা (সামরিক হাসপাতাল): আহত ১৭ জন, নিহত ১২

  5. কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল: আহত ১ জন, নিহত ২

  6. লুবনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টার, উত্তরা: আহত ১১ জন, নিহত ২

  7. উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল: আহত ৬০ জন, নিহত ১

  8. উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতাল: আহত ১ জন, নিহত নেই

এই ৮টি হাসপাতাল মিলিয়ে মোট ১৭১ জন আহত ও চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আহতদের মধ্যে অনেকেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছেন, বিশেষ করে দগ্ধ শিক্ষার্থীরা।

বিমান ও দুর্ঘটনার পটভূমি:
আইএসপিআর আরও জানিয়েছে, বিমান বাহিনীর F-7BGI (৭০১) মডেলের প্রশিক্ষণ বিমানটি ছিল এটি। এ ধরনের বিমান সাধারণত উচ্চগতিতে প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয় এবং এটি একজন বৈমানিক দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে।

বিমানটি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে উড্ডয়ন করে, এবং মাত্র ১২ মিনিটের মাথায় দুর্যোগপূর্ণ যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়ে এটি বিধ্বস্ত হয়।

বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর ট্যাংকে থাকা জ্বালানিতে বিস্ফোরণ ঘটে এবং ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অনেক শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয় এবং বহু শিক্ষার্থী আগুনে দগ্ধ হয়।

বিমানচালকের সাহসী ভূমিকা:
দুর্ঘটনার সময় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিমানটিকে জনবসতি এড়িয়ে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তার এই সাহসিকতা বড় ধরনের প্রাণহানি থেকে অনেকটাই রক্ষা করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

উদ্ধার ও চিকিৎসা:
দুর্ঘটনার পরপরই ফায়ার সার্ভিস, র‍্যাব, পুলিশ ও বিমান বাহিনীর উদ্ধার টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে। দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীকে দ্রুত উদ্ধার করে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়। আহতদের মধ্যে ৭০ জনকে নেওয়া হয় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে।

দগ্ধদের মধ্যে অনেকেই জীবনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। সিএমএইচ ও বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা দিনরাত কাজ করছেন আহতদের বাঁচাতে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়:
একজন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, “বিমানটি হঠাৎ করেই বিকট শব্দে নিচে নামতে শুরু করে। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শুনি এবং দেখি আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ছে।”

একজন শিক্ষার্থী জানান, “ক্লাস চলছিল, হঠাৎ কম্পন অনুভব করি। এরপর বিকট শব্দে ছাদ ভেঙে পড়ে এবং চারপাশে আগুন ছড়িয়ে যায়। অনেকেই চিৎকার করছিল, কেউ কেউ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।”

সরকারি প্রতিক্রিয়া ও তদন্ত:
সরকার ইতোমধ্যে দুর্ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং বিমানটির ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার কাজও শুরু হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন এই দুর্ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।


উত্তরার বিমান বিধ্বস্তের এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা গোটা দেশকে নাড়া দিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন দুর্ঘটনা আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর প্রশ্ন তোলে। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে আরও সতর্কতা, নিরাপত্তা ও পরিকাঠামো জোরদার করার দাবি উঠেছে। আহতদের দ্রুত সুস্থতা এবং নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।