সাত গম্বুজ মসজিদ ও অজানা সমাধির গল্প

সাত গম্বুজ মসজিদ
সাত গম্বুজ মসজিদ

ঢাকার জমজমাট জীবনের ভিড় থেকে সরে এসে আড়ম্বরহীন শান্তির খুঁজে পেতে পারলেন কি? শুক্রবারের কোনো এক ঝলমলে ছুটির দিনে মোহাম্মদপুরে ঘুরে আসুন দুই নীরব প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে—সাত গম্বুজ মসজিদ ও তার স্নেহঢাকা ‘অজানা সমাধি’। ইতিহাসের পাতায় যে অধ্যায়গুলো আজো অমলিন, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে এই দুই স্মৃতিস্তম্ভ।


ইতিহাসের পাতায় সাত গম্বুজ মসজিদ

১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে মোঘল সাম্রাজ্যের সুবেদার শায়েস্তা খাঁর প্রভুত্ব বাংলা আখ্যায়িত ছিল শান্তিময়। তাঁর পুত্র উমিদ খাঁ মোগল স্থাপত্যরীতিতে মোহাম্মদপুরে নির্মাণ করেন এক বুড়িৎ নিদর্শন—সাত গম্বুজ মসজিদ। লাল বাগ দুর্গ মসজিদ ও খাজা আম্বর মসজিদের শৈলীতে এ মসজিদ স্থাপন করা হয়েছিল। ১৫ ফুট উঁচু প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে এ মসজিদ; দেড় শতকের বেশি সময় পার হলেও এর লাল ইটের অলঙ্কার আজো আভিজাত্য আবিষ্কার করে।

মসজিদের ছাদে তিনটি বড় গম্বুজ—মগ্র মরুভূমির সমতলে নজিরবিহীন আর চার কোণে ছোট গম্বুজ চারটি, যা স্থাপত্যগত ভারসাম্য বজায় রাখে। চার কোণে মিনার, টার্নিং খিলান, ইটের কারুকাজ ও খচিত মেহরাব— সবই সেই সময়কার শিল্পীর দক্ষতার সাক্ষ্য বহন করে। মসজিদের দেয়ালে সিমেট্রিকাল খিলান, অষ্টধাতু খিলঞ্জি ও জ্যামিতিক নকশা মুগ্ধ করে প্রতিটি দর্শককে।

মসজিদের অভ্যন্তরে প্রার্থনার স্থান চার সারিতে সাজানো। প্রায় ৯০ জন মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারে। এর সামনের প্রশস্ত বারান্দা ও উদ্যান এককালের বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী গঞ্জনা স্মরণ করিয়ে দেয়, যখন লঞ্চ-স্টিমাররা ধারে ঘাট জমজমাট করে যেত। আজ সে গমগম হারিয়ে গেলেও স্মৃতিস্তম্ভ নিজ রূপে অব্যাহত।


অজানা সমাধির রহস্য

মসজিদ থেকে মাত্র কয়েকশো গজ দূরে আছে এক ‘অজানা সমাধি’। স্থানীয়দের কাছে ‘বিবির মাজার’ নামেও পরিচিত। বাইরের দিকে চতুষ্কোণ আকৃতির এ সমাধি, ভেতরে অষ্টকোণাকার—মোগল ধাঁচের একটি ছোট গম্বুজ বেষ্টিত। কার কবর, সম্রাটদের কোনো ডায়েরি না থাকায় জানা আজও কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি। ইতিহাসবিদদের অনুমান, হয়তো মসজিদের কোনো বরেণ্য মুসলিম নেতা বা সুফি সাধকের সমাধি, আবার কেউ কেউ বলেন, শায়েস্তা খাঁর কন্যার مساادى হতে পারে।

বহুকাল পরিত্যক্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত এ স্থানের পুনরুদ্ধার হয় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে আজ এটি নতুন রূপে দাঁড়িয়ে আছে। পুরনো পাচঁ-ছয়টি ইটের পাত ভেঙে যেতে যেতে আজাব দাঁড়িয়ে থাকা মাটির প্রাচীরগুলোতে আবার সাজাল বেহালকার, যেন ইতিহাসের কণ্ঠস্বর ঘুরে ফিরে আসে প্রত্যেক দিক থেকে।


দর্শনীয় স্থান ও সুবিধা

অবস্থান ও যাতায়াত

মোহাম্মদপুর রিং রোড ধরে মণিপুরীপাড়া বা বসিলা রোডের দিকে আসলেই চোখে পড়বে সূক্ষ্ম সাইনবোর্ড। সরু গলি পেরিয়ে প্রবেশের পর সামনে মসজিদ, পাশেই সমাধি—সবই এক চাহনিে।

  • ব্যক্তিগত যানবাহন: রিং রোড থেকে সহজেই উল্টে ছোট রাস্তা দিয়ে প্রবেশ

  • রিকশা: মোহনপুর পয়েন্ট বা রিং রোডের যেকোনো পয়েন্ট থেকে রিকশায় ১০–১৫ মিনিটে পৌঁছানো যায়

  • পার্কিং: সামান্য স্থান থাকলেও বাইকে পার্কিং সুবিধা রয়েছে

আশেপাশের আকর্ষণ

  • লালমাটিয়া ও তাজমহল রোড: এখানের কাবাব, চাপ, বিরিয়ানি বিখ্যাত—দু’মুঠো খাবারে ভ্রমণী ক্লান্তি ভুলিয়ে দেবে

  • বুড়িগঙ্গা ঘাট: পূর্বজলের স্মৃতি ধরে রাখা ঘাটের ধারে একটি নীরব উদ্যান


পরিদর্শন পরামর্শ

  1. সময় নির্বাচন: সকালবেলায় সূর্য ওঠার আগে বা বিকেলের হালকা আলোতে মসজিদ ও সমাধি পরিদর্শন উপভোগ্য

  2. পোষাক: ধর্মীয় স্থান হওয়ায় লম্বা, ঢাকনো পোশাক পরিধান করলে সম্মানজনক হয়

  3. ফটোগ্রাফি: স্থাপত্যের অলঙ্কার, খিলান ও মিনারের ডিটেইল শুট করতে পৌঁছে

  4. গাইড: স্থানীয় উপাখ্যায়ি বা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের গাইড থাকলে ইতিহাস বোঝা সহজ


উপসংহার

ঢাকার কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন এই নিস্তব্ধ স্থানে দাঁড়ালে মনে হবে একরাশ ইতিহাসের নিঃশব্দ সাক্ষী সামনে। সাত গম্বুজ মসজিদের সুউচ্চ ইটের কারুকাজ, তার পাশের অজানা সমাধির রহস্যময়তা—সবই মানুষকে অতীতের অমলিন অধ্যায়ে পা রাখতে উদ্বুদ্ধ করে। একদিনের ছুটিতে বা সপ্তাহান্তের কোনো সকালে এই দুই নিদর্শন আড্ডা দিতে আসা মানে কেবল ভ্রমণ নয়; ইতিহাসের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতা।