বাংলাদেশ ও কাতার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) সরবরাহ চুক্তি নবায়নের মাধ্যমে। সম্প্রতি দোহায় অনুষ্ঠিত ‘আর্থনা সামিট’-এর সাইডলাইনে এই সিদ্ধান্ত আসে, যেখানে কাতারের জ্বালানিমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আলোচনায় উঠে আসে কেবল বিদ্যমান সমঝোতা স্মারক (MoU) নবায়ন নয়, বরং ভবিষ্যতের জ্বালানি নিরাপত্তা ও অবকাঠামো নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার সম্ভাবনা।
দীর্ঘমেয়াদি SPA ও MoU নবায়নের প্রেক্ষাপট
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ও কাতার G2G ভিত্তিক একটি Sales and Purchase Agreement (SPA) স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ প্রতি বছর ১.৫ থেকে ২.৫ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানি করে থাকে। প্রতি বছর প্রায় ৪০টি এলএনজি কার্গো এভাবে সরবরাহ করা হয়।
২০২৩ সালে নতুন আরেকটি SPA সই হয়, যার কার্যকারিতা শুরু হবে ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে। এই নতুন চুক্তির আওতায় আরও ১.৫ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানি করা হবে প্রতি বছর। এই SPA-এর সাপোর্টিং MoU ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়, যার নবায়নের প্রতিশ্রুতি কাতার দিয়েছে।
কাতারের প্রতিশ্রুতি: সহযোগিতা আরও গভীর হবে
কাতারের জ্বালানিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সাদ বিন শেরিদা আল কাবি বলেন, "আমরা শুধু বাংলাদেশে গ্যাস সরবরাহ করতে চাই না, বরং এই খাতে বাংলাদেশের সাথে টেকসই অংশীদারত্ব গড়তে চাই।" তিনি আরও জানান, কাতার তাদের এলএনজি উৎপাদন দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এর ফলে আগামীতে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমতে পারে, যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত লাভজনক হবে।
বাংলাদেশের পরিকল্পনা: স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল
বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে মাতারবাড়ী, কক্সবাজারে একটি স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। বর্তমানে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল দিয়ে দেশে বছরে ১১৫টি কার্গো হ্যান্ডল করা সম্ভব হচ্ছে। তবে এই সক্ষমতা ভবিষ্যতে চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়।
স্থলভিত্তিক টার্মিনালের মাধ্যমে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরাসরি গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প ও আবাসিক ব্যবহারকারীদের জন্য সুবিধাজনক হবে। এই টার্মিনাল থেকে রিগ্যাসিফায়েড এলএনজি (RLNG) সরবরাহ করা হবে, যা বর্তমান এলএনজি ব্যবস্থার চেয়ে আরও স্থায়ী ও ব্যয়সাশ্রয়ী হবে।
ইউরিয়া সার সরবরাহেও কাতারের আগ্রহ
এলএনজির পাশাপাশি কাতার বাংলাদেশে ইউরিয়া সার সরবরাহ বাড়াতে চায়। দেশের কৃষিখাত ইউরিয়া সার নির্ভর, এবং বছরে কয়েক মিলিয়ন টন সার আমদানি করা হয়। কাতারের প্রতিমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশের কৃষি খাতের উন্নয়নে আমরা ভূমিকা রাখতে আগ্রহী।”
উচ্চপর্যায়ের উপস্থিতি: বৈঠকের গুরুত্ব
এই বৈঠকে কেবল দুই দেশের প্রধান উপদেষ্টা নয়, উপস্থিত ছিলেন আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। যেমন—পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আশিক মাহমুদ, টেকসই উন্নয়ন সচিব লামিয়া মোর্শেদ এবং জ্বালানি সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। এ থেকেই বোঝা যায়, এই আলোচনা কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের।
জ্বালানি নিরাপত্তা ও কৌশলগত প্রয়োজন
বাংলাদেশে গ্যাস একটি প্রাথমিক জ্বালানি উৎস, বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্পখাতে। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন ক্রমাগত কমে যাচ্ছে, ফলে আমদানি নির্ভরতা বেড়ে চলেছে। বর্তমানে দৈনিক প্রায় ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি হচ্ছে, এবং এই পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে কাতারের মতো নির্ভরযোগ্য দেশ থেকে এলএনজি সরবরাহ একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে বাজারে অস্থিরতা কমানো এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হবে।
ভবিষ্যতের রূপরেখা
বাংলাদেশ ও কাতার দু’দেশই বুঝতে পেরেছে যে একে অপরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। কাতারের টেকনিক্যাল সক্ষমতা, অভিজ্ঞতা এবং উচ্চমানের গ্যাস উৎপাদন বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ একটি উদীয়মান অর্থনীতি, যেখানে জ্বালানি একটি মৌলিক চালিকাশক্তি।
দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা শুধু বাণিজ্যিক নয়, বরং কৌশলগত। এই অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ জ্বালানি খাতে যেমন আত্মনির্ভর হতে পারবে, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়ও সম্ভব হবে।