কোরআনে কারুন: ধন-সম্পদের অহংকার ও আল্লাহর শাস্তি

মিশরের ফাইয়ুমে, কারুন হ্রদের তীরে অবস্থিত কাস্রে কারুন অতীতের স্মৃতিবাহী এক অটুট নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
মিশরের ফাইয়ুমে, কারুন হ্রদের তীরে অবস্থিত কাস্রে কারুন অতীতের স্মৃতিবাহী এক অটুট নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।

কোরআনের ইতিহাসে কারুন (কারুন) এমন এক ব্যক্তিত্ব, যে তাঁর ঢলুনেলে ভরা সম্পদের কারণে নিজ সম্প্রদায়কে ভুল পথে নিয়ে যাবার জন্য পরিচিত। যদিও তিনি নবী মূসা (আ.)-এর সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন, অন্তরে তিনি ফেরাউনের পক্ষপोषক ছিলেন। বাহ্যিকভাবে মূসার (আ.) পক্ষে অবস্থান করলেও অন্তরে তার প্রতি ছিল ঘৃণা। তাঁর এই মোড়লমনা দম্ভ আর কপট আচরণই নিয়ে আল্লাহ তাআলা তাঁকে ধ্বংসের মাধ্যমে ন্যায়বিচার করেন।


কারুনের পটভূমি ও কুরাইশবিন্দু

কারুন ছিলেন নবী মূসার (আ.) সম্প্রদায়েরই লোক, যারা মিশরীয় ফেরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়েছিল। আল্লাহ তাঁকে অসামান্য জ্ঞান-গরিমা ও বিশাল সম্পদ দান করেন। সুরা কাসাসে বর্ণিত হয়েছে, তাঁর ধন-সম্পদের চাবি বহন করা পর্যন্ত শক্তিশালী লোকদের পক্ষে কষ্টসাধ্য ছিল।

“আমি তাকে এত ধন-ভান্ডার দান করেছিলাম, যার চাবি বহন করা কয়েকজন শক্তিশালী লোকের পক্ষেই কষ্টসাধ্য ছিল। কিন্তু সে দম্ভ করল...” (সুরা কাসাস: ৭৭)


ধন-সম্পদের দম্ভ ও অন্যায় ব্যবহার

অতি সম্পদকে উপলক্ষ্য করে কারুন তার সম্পদের রক্ষা-সংরক্ষণ আর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ না করে অন্যদের প্রতি অবিচার শুরু করেন। তিনি:

  • দান-সদকা না দিয়ে সম্পদের অধিকার আদায়ে লিপ্ত

  • অনগ্রসরদেরকে অবহেলা ও তুচ্ছজ্ঞান

  • দারিদ্র্যের মধ্যে হাঁটা মানুষকে উপেক্ষা ও অবমাননা

এই কারণে নবী মূসা (আ.) বহুবার তাকে হেদায়াতের পথে আসতে আহ্বান করেন, কিন্ত কারুন অবিচল থাকেন।


কোরআনে কারুনের উল্লেখ: ফেরউন ও হামানের সাথে তুলনা

কারুনের ধ্বংসকাহিনী সুরা গাফিরে এবং সুরা আনকাবুতেও বর্ণিত:

  • সুরা গাফির (৪০:২৩-২৪):
    “আমি মূসাকে আমার নিদর্শন ও সুস্পষ্ট প্রমাণসহ প্রেরণ করেছিলাম ফেরউন, হামান ও কারুনের কাছে; কিন্তু তারা বললো, ‘এ তো এক মিথ্যাবাদী জাদুকর।’”

  • সুরা আনকাবুত (২৯:৩৯):
    “আর কারুন, ফেরউন ও হামান! মূসা তাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে এসেছিল, কিন্তু তারা পৃথিবীতে অহংকার করেছিল; আর তারা আমার শাস্তি থেকে পালাতে পারেনি।”

এসব আয়াত থেকে বোঝা যায়, কারুনের অবস্থান ফেরাউন-হামানের দলে গন্য হয়, কারণ তিনিও ধন-সম্পদে অহংকারকারী ও আল্লাহর প্রেরিত নিদর্শন অগ্রাহ্যকারী ছিলেন।


আল্লাহর শাস্তি: সম্পদসহ ধ্বংস

সর্বশেষে আল্লাহ তাআলা তাঁর সব সম্পদসহ কারুনকে ভূমিগর্ভে বিলীন করে দেন। কোরআনের ভাষায়:

“তার সম্প্রদায় যখন বলল, ‘দম্ভ করো না, আল্লাহ দাম্ভিকদের ভালোবাসেন না...’, তখন আমি কারুনকে ও তার প্রাসাদকে জমিনে ডুবিয়ে দিলাম। তার পক্ষে আর কোনো শক্তিও ছিল না।”
(সুরা কাসাস: ৭৬–৮৩)

এই ঘটনার পরকারদের জ্ঞান হলো—অহংকারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির মদত কেউই দিতে পারে না; বরং আল্লাহই সকল ক্ষমতার আসল মালিক।


শিক্ষণীয় উপদেশ

কারুনের ঘটনা থেকে আমরা যে শিক্ষা নিতে পারি, তা হলো:

  • সম্পদের দায়িত্ব: ধন শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি সমষ্টিগত কল্যাণে ব্যয় করতে হবে।

  • ইমান ও আমল: আল্লাহ প্রদত্ত নিদর্শন অগ্রাহ্য করলে ধ্বংস অনিবার্য।

  • দম্ভ পরিহার: উচ্চস্বরে নিজের গুণ গাইলে তা সাধারণ মানুষের তীব্র ঘৃণা ডেকে আনে।

  • অহংকারের পরিণতি: দম্ভকারীরা একদিন তাদের দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে পালাতে পারবে না।


উপসংহার

কোরআনে কারুনের কাহিনী মানব জাতিকে সতর্ক করে যে, আল্লাহর অনুগ্রহবিনা সম্পদ কেবল ধ্বংসের কারণ হতে পারে। ইবাদত, দান-সদকা ও ধৈর্যই প্রকৃত শৃঙ্খলা ধরে রাখে। তাই আমাদের উচিত কারুনের দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা নিয়ে অহংকার পরিহার, সাহায্য সহযোগিতা বৃদ্ধি ও আল্লাহর নির্দেশনায় চলা।