মেট্রোরেল দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবারকে ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ: হাইকোর্ট রুল

মেট্রোরেল দুর্ঘটনায় ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ রুল; বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন
মেট্রোরেল দুর্ঘটনায় ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ রুল; বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন

রাজধানীর দ্রুতগতির গণপরিবহন মেট্রোরেলের নির্মাণ এবং পরিচালনার মান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিল একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। গত ২৬ অক্টোবর, রোববার, ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের ভায়াডাক্ট থেকে একটি ভারী বিয়ারিং প্যাড আকস্মিকভাবে খুলে নিচে পথচারী আবুল কালাম আজাদের (শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঈশরপাটি গ্রামের বাসিন্দা) মাথায় আঘাত হানে। ঘটনাস্থলেই গুরুতর আহত হয়ে মারা যান তিনি। এই ভয়াবহ ঘটনা কেবল একটি প্রাণহানি নয়, বরং দেশের অন্যতম মেগা প্রকল্পের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতির এক বড় ইঙ্গিত।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। বুধবার (২৯ অক্টোবর), বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি আসিফ হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ একটি যুগান্তকারী আদেশ জারি করেছেন।

 

আদালতের দ্বিমুখী নির্দেশ: রুল এবং বিশেষজ্ঞ কমিটি

হাইকোর্ট এই ঘটনায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আদেশ দিয়েছেন। প্রথমত, নিহত আবুল কালাম আজাদের পরিবারকে ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়ে রুল জারি করেছেন। দ্বিতীয়ত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আদালত মেট্রোরেল ও দেশের অন্যান্য ফ্লাইওভারের সার্বিক নিরাপত্তা এবং দুর্ঘটনার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন। কমিটিকে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে হাইকোর্টে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট দাখিল করতে বলা হয়েছে।

 

আইনি লড়াইয়ের নেপথ্যে

আদালতে এই বিষয়ে রিটের পক্ষে শুনানি করেন সুপ্রিম কোর্টের প্রথিতযশা আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন এবং অ্যাডভোকেট তানভীর আহমেদ। ঘটনার পরপরই আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

১. প্রথম রিট: ঘটনার দুই দিন পর, গত সোমবার (২৭ অক্টোবর) আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন মেট্রোরেলসহ দেশের সব ফ্লাইওভারের বিয়ারিং প্যাডের গুণগত মান যাচাইয়ে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে প্রথম রিটটি দায়ের করেন। রিট আবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়, দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই অবকাঠামোগুলিতে ব্যবহৃত বিয়ারিং প্যাডের মান কতটা নিরাপদ ও টেকসই, তা বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে যাচাই করা জরুরি। ২. দ্বিতীয় রিট (ক্ষতিপূরণ): পাশাপাশি, মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে নিহত হওয়া পথচারী আবুল কালাম আজাদের পরিবারকে দ্রুত দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশনা চেয়ে আরেকটি রিট আবেদন করা হয়।

হাইকোর্ট এই দুটি রিট আবেদন একত্রিত করে বুধবার উপরোক্ত আদেশ প্রদান করেন। এই রুল জারির মাধ্যমে আদালত স্পষ্ট বার্তা দিলেন যে, জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া কর্তৃপক্ষের অপরিহার্য দায়িত্ব।

 

কী এই বেয়ারিং প্যাড এবং কেন এটি খুলে পড়ল?

বিশেষজ্ঞদের মতে, বেয়ারিং প্যাড হলো সেতু বা উড়াল পথের (যেমন, মেট্রোরেল বা ফ্লাইওভার) একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি সাধারণত নিওপ্রেন বা প্রাকৃতিক রাবার দিয়ে তৈরি হয় এবং পিলারের (পিয়ার) সঙ্গে উড়াল পথের কাঠামোকে (ভায়াডাক্ট) সংযোগ করে। এর মূল কাজ হলো ট্রেনের চলাচল বা গাড়ির কারণে সৃষ্ট কম্পন শোষণ করা এবং কাঠামোর তাপীয় প্রসারণ ও সংকোচনজনিত চাপ সামলানো। এটি অত্যন্ত ভারী হয়।

দুর্ঘটনার পর মেট্রোরেল সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা প্রাথমিক তদন্তে জানান, প্যাডটি সঠিকভাবে সংযুক্ত ছিল না বা এর ফিক্সিংয়ে কোনো ত্রুটি ছিল। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, নকশাগত ত্রুটি অথবা নির্মাণকালীন দুর্বলতা এর জন্য দায়ী হতে পারে। বেয়ারিং প্যাড সাধারণত ইস্পাতের শেকলে বাঁধা থাকে, যা এর স্থানচ্যুতি রোধ করে। এটি খুলে পড়া একটি অত্যন্ত বিরল এবং মারাত্মক ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত। এই ঘটনা মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা প্রোটোকল নিয়ে গভীর সংশয় তৈরি করেছে।

 

নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ: জনমনে প্রশ্ন

মেট্রোরেলের মতো একটি অত্যাধুনিক এবং জনবহুল গণপরিবহন ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ খুলে পড়ে মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনা সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন উঠেছে:

  • মেট্রোরেলের রক্ষণাবেক্ষণের মান কেমন?

  • নির্মাণ শেষে নিয়মিত গুণগত মান যাচাই করা হয় কি না?

  • বাংলাদেশের অন্যান্য ফ্লাইওভারগুলোতেও এমন ঝুঁকি রয়েছে কি না?

হাইকোর্ট কর্তৃক বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশনা ঠিক এই উদ্বেগগুলির সমাধান করতে পারে। এই কমিটির দেওয়া রিপোর্ট ভবিষ্যতে দেশের সকল উড়াল পথের নিরাপত্তার মান নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

আবুল কালাম আজাদের মৃত্যু এবং হাইকোর্টের রুল জারির ঘটনা মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণকারী সংস্থাগুলোর জন্য একটি সতর্কবার্তা। ক্ষতিপূরণের রুল এবং বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ কেবল নিহত পরিবারের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার প্রাথমিক পদক্ষেপ নয়, বরং এটি দেশের অবকাঠামো নিরাপত্তা নিশ্চিত করার একটি মাইলফলক। এখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জন্য অপেক্ষা, তারা কীভাবে আদালতের নির্দেশনা পালন করে এবং আগামী ৩০ দিনের মধ্যে তারা বিশেষজ্ঞ কমিটিকে কী ধরনের সহযোগিতা প্রদান করে।