সমবায় সমিতি বা ক্ষুদ্র ঋণদান প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছু গ্রাহক সমিতি থেকে ঋণ বা লোন গ্রহণ করে ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা ছলচাতুরি করে তা পরিশোধ করেন না। এমন পরিস্থিতিতে সমিতির আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু, আইন অনুযায়ী, এমন ঋণখেলাপি গ্রাহকের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
ধাপে ধাপে করণীয়: সমিতির লোন খেলাপি গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে পারে, যা মূলত সমবায় সমিতি আইন, ২০০১ এবং চুক্তির ওপর নির্ভরশীল:
১. প্রাথমিক যোগাযোগ ও সতর্কতা (নোটিশ): বকেয়া কিস্তি নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম করলে প্রথমেই গ্রাহককে মৌখিক বা লিখিতভাবে সতর্ক করতে হবে। সমস্যার প্রকৃত কারণ জেনে যদি সমাধানে আসা না যায়, তবে সমিতি আনুষ্ঠানিক ডিমান্ড নোটিশ পাঠাবে। নোটিশে বকেয়া অর্থের পরিমাণ, সুদ ও দ্রুত পরিশোধের সময়সীমা উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক।
২. নিবন্ধকের কাছে বিরোধ নিষ্পত্তি আবেদন: যদি নোটিশের পরেও গ্রাহক সাড়া না দেন, তবে সমবায় সমিতি আইন, ২০০১ এর ধারা ৮১ অনুযায়ী, পাওনা আদায়ের জন্য সমিতি সমবায় নিবন্ধক বা তার মনোনীত কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন করতে পারবে। নিবন্ধক তখন খেলাপি সদস্যকে ঋণ পরিশোধের জন্য নির্দেশ বা অ্যাওয়ার্ড দিতে পারেন।
৩. আইনি পদক্ষেপ ও মামলা দায়ের:
-
সমবায় আইনে অ্যাওয়ার্ড কার্যকর: নিবন্ধকের দেওয়া ঋণ পরিশোধের অ্যাওয়ার্ড (Award) কার্যকর করার জন্য সমিতি আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে।
-
অর্থ ঋণ আদালতে মামলা: যদি ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হয় এবং জামানত থাকে, তবে অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো সমিতি উপযুক্ত অর্থ ঋণ আদালতে মামলা দায়ের করতে পারে।
-
চেক ডিজঅনার মামলা: ঋণ নেওয়ার সময় গ্রাহক যদি কোনো চেক দিয়ে থাকেন এবং সেটি অপরিশোধিত (Dishonour) হয়, তবে নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্টস অ্যাক্ট, ১৮৮১-এর ১৩৮ ধারা অনুযায়ী মামলা করা যেতে পারে।
৪. জামানত বাজেয়াপ্তকরণ ও সম্পত্তি ক্রোক: ঋণের বিপরীতে যদি কোনো সম্পত্তি (যেমন জমি, বন্ধক রাখা জিনিসপত্র) জামানত হিসেবে রাখা থাকে, তাহলে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমিতি সেই জামানত বাজেয়াপ্ত করে বা বিক্রি করে পাওনা টাকা আদায় করতে পারে। সমবায় সমিতি আইন, ২০০১ এর ধারা ৮০ অনুযায়ী, নিবন্ধক সম্পত্তি হস্তান্তরের প্রচেষ্টা ঠেকাতে ক্রোকের নির্দেশও দিতে পারেন।
৫. ছলচাতুরির জন্য জরিমানা আরোপ: যদি কোনো গ্রাহক ভুয়া জামানত বা মিথ্যা বিবৃতি দিয়ে ঋণ গ্রহণ করেন, যা প্রতারণার শামিল, তবে সমবায় আইন, ২০০১ এর ধারা ৮২ অনুযায়ী, নিবন্ধক দোষী ব্যক্তির ওপর ঋণের দ্বিগুণ পরিমাণ জরিমানা আরোপ করতে পারেন। এই জরিমানা ফৌজদারী দণ্ডের মতো আদায়যোগ্য।
সমিতির জন্য বার্তা: সমিতি পরিচালকদের মনে রাখতে হবে যে, ঋণ দেওয়া যেমন একটি আর্থিক প্রক্রিয়া, তেমনি ঋণ আদায়ও একটি আইনি প্রক্রিয়া। ঋণ বিতরণের সময় চুক্তির শর্তাবলী অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তৈরি করা এবং খেলাপি হলে দ্রুত ও নিয়মানুযায়ী আইনি পথে পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক। এতে সমিতির আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত হবে এবং ঋণখেলাপির প্রবণতা কমবে।