জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত সাবেক ১২ মন্ত্রী ও ৪ উপদেষ্টাসহ মোট ১৬ জনকে আজ (২০ এপ্রিল, রোববার) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের আদলে যুদ্ধাপরাধ আইন অনুযায়ী বিচারিক কার্যক্রম শুরু করার প্রক্রিয়া চলছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে সকাল থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। পুরো এলাকা ঘিরে রাখা হয়েছে পুলিশ ও র্যাব সদস্যদের দ্বারা। এমনকি সংবাদমাধ্যম এবং সংশ্লিষ্টদের ট্রাইব্যুনালে প্রবেশেও নিরাপত্তা যাচাই প্রক্রিয়া কঠোরভাবে পালন করা হয়েছে।
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
এই ১৬ জনের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টা এবং প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের সাবেক কর্মকর্তারা। এরা হলেন:
-
আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী: আনিসুল হক, ফারুক খান, দীপু মনি, আব্দুর রাজ্জাক, শাজাহান খান, গোলাম দস্তগীর গাজী, আমির হোসেন আমু, কামরুল ইসলাম
-
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি: রাশেদ খান মেনন
-
জাসদ সভাপতি: হাসানুল হক ইনু
-
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা: তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সালমান এফ রহমান
-
সাবেক প্রতিমন্ত্রী: কামাল আহমেদ মজুমদার, জুনায়েদ আহমেদ পলক
-
আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি: এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
-
সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব: জাহাংগীর আলম
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, জুলাই-আগস্ট মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা, গুম, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
তদন্তের অগ্রগতি ও প্রসিকিউশনের অবস্থান
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই ১৬ জনকে হাজির করার দিন নির্ধারণ করে। প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ জানান, “এই ১৬ জনকে আজ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে।”
এছাড়া, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদনও আজ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হচ্ছে। এ বিষয়ে শুনানি হবে ট্রাইব্যুনালের তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে, যেটির নেতৃত্বে আছেন বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার। অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর জানা যাবে তদন্ত সম্পূর্ণ হয়েছে কি না, কিংবা আরও সময় প্রয়োজন কি না।
পূর্বপ্রেক্ষাপট
গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সংঘটিত গণহত্যার অভিযোগে ১২ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, ২ উপদেষ্টা, এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এরপর তাদের শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয় এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি তাদের হাজির করার আদেশ আসে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দীর্ঘদিন ধরেই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করে আসছে। তবে এই প্রথমবার এত বড় সংখ্যক সাবেক মন্ত্রী এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একসঙ্গে অভিযুক্ত করা হলো।
নিরাপত্তা ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে অভিযুক্তদের মধ্যে সরকারদলীয় সাবেক নেতাদের থাকা রাজনৈতিক উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে চলছে নানা বিতর্ক ও বিশ্লেষণ।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এলাকায় ভোর থেকেই কড়া নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলেন, “আমরা সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি যাতে শান্তিপূর্ণভাবে বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন হয়।”
পরবর্তী পদক্ষেপ
আসামিদের আজ আদালতে হাজির করা হলেও এখনই তাদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হবে না। প্রথমে তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করা হবে, এরপর অভিযোগ গঠনের শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। যদি ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গ্রহণ করে, তখন বিচারিক কার্যক্রম শুরু হবে।
তদন্তে যদি প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে এই ১৬ জনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ আইনে সর্বোচ্চ সাজা হতে পারে মৃত্যুদণ্ড। তবে সবকিছু নির্ভর করবে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের উপর।
এ ধরনের একটি ঘটনা বাংলাদেশের আইনি ও রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সাবেক মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়ার অংশ হওয়া নিঃসন্দেহে একটি বড় পদক্ষেপ। এ ঘটনার বিচার সঠিকভাবে সম্পন্ন হলে তা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হবে।